ডিজিটাল যুগে বইয়ের আকর্ষণ: ওঙ্গোল বইমেলা যখন আশার আলো

একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে আমরা এমন এক ডিজিটাল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে তথ্য ও বিনোদন হাতের মুঠোয়। স্মার্টফোনের স্ক্রিনে রিল এবং ছোট ছোট ভিডিওর ভিড়ে আমাদের মনোযোগ ক্রমেই খণ্ডিত হয়ে পড়ছে। বিশ্বজুড়ে বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। অক্সফোর্ড কর্তৃক ২০২৪ সালের বর্ষসেরা শব্দ ‘ব্রেইন রট’ (Brain Rot) বা ‘মস্তিষ্কের ক্ষয়’ এই বাস্তবতারই প্রতিচ্ছবি। ঠিক এমন একটি সময়ে ভারতের ওঙ্গোলে আয়োজিত বই উৎসব যেন এক ঝলক তাজা বাতাসের মতো, যা সব বয়সের মানুষকে আবারও বইয়ের জগতে ফিরিয়ে আনছে।

পর্দার যুগ বনাম বইয়ের জগৎ

মাত্র কয়েক দশক আগেও একটি বই খুঁজে বের করা ছিল রীতিমতো একটি অভিযানের মতো। লাইব্রেরিতে গিয়ে ক্যাটালগ কার্ডের ড্রয়ার খুলে, শত শত কার্ডের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট বইটি খুঁজে বের করার মধ্যে ছিল এক ধরনের উত্তেজনা এবং ধৈর্য্যের পরীক্ষা। কিন্তু আজ, যখন ভারতে প্রায় ৯০ কোটি মানুষের কাছে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে এবং সাক্ষরতার হার ৭৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে, তখন যেকোনো বই বা গবেষণাপত্র খুঁজে পাওয়া মাত্র কয়েক ক্লিকের ব্যাপার। তবুও विरोधाभाস হলো, বইয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ আগের চেয়ে কমেছে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল লিটারেসি ট্রাস্টের এক জরিপে দেখা গেছে, ৮ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে মাত্র ৩৪.৬ শতাংশ বই পড়তে ভালোবাসে, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই শূন্যস্থান পূরণ করছে ডিজিটাল কনটেন্ট, যা আমাদের গভীর মনোযোগ কেড়ে নিয়ে ক্ষণস্থায়ী ডোপামিন নিঃসরণে সীমাবদ্ধ রাখছে। এর ফলে মানুষের মধ্যে মনোযোগের ঘাটতি, স্মৃতিশক্তি হ্রাস এবং চিন্তাভাবনার বিকৃতি ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

ওঙ্গোল বইমেলা: একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

এই বৈশ্বিক চিত্রের বিপরীতে ওঙ্গোল বই উৎসবের তৃতীয় দিনের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছুটির দিন হওয়ায় রবিবার মেলা প্রাঙ্গণে ছিল পাঠক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের উপচে পড়া ভিড়। বইয়ের স্টলগুলোতে প্রাণবন্ত এক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, যা প্রমাণ করে ডিজিটাল মাধ্যমের শত আকর্ষণের পরেও বই তার আবেদন হারায়নি। সব বয়সের মানুষের সমাগম ঘটলেও শিশুদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো।

এবারের মেলায় শিশুদের গল্পের বই এবং অ্যাক্টিভিটি বইগুলো ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। ছোটদের কমিকস ও বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি বই খুঁজতে দেখা গেছে, অন্যদিকে অভিভাবকরা অ্যাটলাস এবং প্রবন্ধ লেখার গাইডের মতো শিক্ষামূলক বই কিনেছেন। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের (এনবিটি) উদ্যোগে এদিন বিকেল ৩টা থেকে একটি সৃজনশীল লেখা কর্মশালার আয়োজন করা হয়। মঞ্জুলুরু কৃষ্ণ কুমারী এবং সিএ প্রসাদের পরিচালনায় প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থী এই কর্মশালায় অংশ নেয়। কেউ তাদের প্রিয় গল্প লিখেছে, আবার কেউ নিজের পছন্দের বিষয়ে ছবি এঁকেছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় ‘জন বিজ্ঞান বেদিকা’ আয়োজিত শিক্ষামূলক ম্যাজিক শো শিশুদের भरपूर আনন্দ দেয়।

বই-ই প্রকৃত সম্পদ: নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা

দিনের প্রধান আকর্ষণ ছিল সন্ধ্যা ৬টায় এনবিটি-র তত্ত্বাবধানে পাঁচটি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। এনবিটি কর্মকর্তা পাত্তিপাকা মোহনের সঞ্চালনায় প্রকাশিত বইগুলো হলো: ‘জুজুরানা’, ‘মাঞ্চি মিত্রুলু’, ‘শেরা-মিত্তু’, ‘বুজ্জি গুডলাগুবা বালু’ এবং ‘তোকালা কথা’। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জয়েন্ট কালেক্টর রোনানকি গোপাল কৃষ্ণ।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে শ্রী গোপাল কৃষ্ণ বলেন, “বই-ই হলো প্রকৃত সম্পদ যা একজন মানুষ অর্জন করতে পারে।” তিনি তার নিজের জীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, হায়দ্রাবাদের একটি বইমেলাই তাকে তেলেগু সাহিত্যের প্রেমে পড়তে সাহায্য করেছিল, যা পরবর্তীতে ইউপিএসসি পরীক্ষায় তাকে সহায়তা করে। তিনি হায়দ্রাবাদ ও বিজয়ওয়াড়ার মতো বড় শহরের বইমেলার পাশাপাশি ওঙ্গোলে এমন একটি সফল আয়োজনের জন্য উদ্যোক্তাদের প্রশংসা করেন। এরপর প্রকাশম জেলার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাদের জীবনে প্রভাব ফেলেছে এমন বই নিয়ে আলোচনা করেন। উৎসবের পরবর্তী দিনে শিশুদের জন্য মাটির কারুশিল্প কর্মশালা, বিশাালান্ধ্র বুক হাউসের বই প্রকাশনা এবং ‘গ্রন্থাগার ও সমাজ’ শীর্ষক একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে।

ডিজিটাল মাধ্যমের কারণে সৃষ্ট মনোযোগের সংকটের এই যুগে ওঙ্গোল বই উৎসবের মতো আয়োজন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বই পড়ার গভীর আনন্দ এবং এর প্রয়োজনীয়তা এখনও ফুরিয়ে যায়নি। এটি প্রমাণ করে, সঠিক উদ্যোগ নেওয়া হলে বইয়ের জাদুকরী আবেদন দিয়ে সব বয়সের পাঠককে আকৃষ্ট করা সম্ভব।