সাহিত্য ও সংগীতের পথে: শব্দ ও সুরে বাঁধা জীবনের গল্প

দুই জগতের সংযোগ: সাহিত্য ও সংগীতের সংলাপ

সংগীত ও সাহিত্যের দুই ভিন্ন শাখা—যেখানে একদিকে সুরের আবেগ, অন্যদিকে শব্দের শক্তি। দক্ষিণ কোরিয়ার সংগীত সমালোচক ও লেখক পার্ক সোহিয়নের বই ‘বইয়ের পাতায় মিশে থাকা ক্লাসিক’ ঠিক এই দুই জগতের মাঝে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করেছে।

পার্ক সোহিয়ন, যিনি অস্ট্রিয়ার বিখ্যাত সংগীত বিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন, দীর্ঘদিন ধরে ক্লাসিক সংগীত ও সাহিত্যকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে চলেছেন। তার বইটি কেবল সংগীতের পরিচয় দেয় না, বরং বিশ্লেষণ করে কীভাবে সাহিত্য ও সংগীত পরস্পরকে প্রভাবিত করেছে, এবং যুগ যুগ ধরে একে অপরকে সমৃদ্ধ করেছে।

সাহিত্য থেকে সংগীতের যাত্রা: চারটি অধ্যায়ে সাজানো অন্বেষণ

বইটি মোট চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়ে হরুকি মুরাকামি, পার্ট্রিক জুসকিন্ড এবং কোরিয়ার সমকালীন লেখকদের সাহিত্যে ক্লাসিক সুরের উপস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে উঠে এসেছে শেক্সপিয়ার, টলস্টয় ও গ্যোতের মতো সাহিত্যিকদের কাহিনিতে বিখ্যাত সংগীতের প্রভাব।

তৃতীয় অধ্যায়ে পাঠক খুঁজে পাবেন হেসে, পুশকিন, ওস্কার ওয়াইল্ডদের মত কবি ও চিন্তাবিদদের রচনার মধ্যে সংগীতের নান্দনিক উপস্থিতি। শেষ অধ্যায়ে থ্রিলার, প্রবন্ধ ও লেখকের পছন্দের সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সংগীতের লুকানো দিক তুলে ধরা হয়েছে।

পাঠ ও শ্রবণের যুগলবন্দি

এই বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো—পাঠক QR কোড স্ক্যান করে সরাসরি সংগীত শুনতে পারেন, যা লেখক নিজেই রেকর্ড করেছেন। এভাবে পাঠের অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে আরও জীবন্ত ও অনুভবযোগ্য।

পার্ক সোহিয়নের বিশ্বাস—“ক্লাসিক সংগীত আমাদের জীবনের বাইরে নয়, বরং প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার মধ্যেই জড়িয়ে আছে।” এই বিশ্বাসই তাঁর লেখনীতে প্রতিফলিত হয়েছে।

ব্যক্তিগত যাত্রার রূপক: গোলাপি দিকনির্দেশনা রেখা

এদিকে, লেখিকা ইফুংগিয়ং তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘গোলাপি দিকনির্দেশনা রেখা’-তে তুলে ধরেছেন এক নারীর জীবনসংগ্রামের গল্প—যেখানে রাস্তার একটি গোলাপি রেখা শুধু গাড়ির পথ নয়, জীবনেরও পথ দেখিয়েছে।

৫০ বছর বয়সে এসে এই ‘গোলাপি দিকনির্দেশনা রেখা’ প্রথমবার দেখতে পান লেখিকা। তাঁর চোখে এটি ছিল জীবনের মোড় ঘোরানো এক প্রতীক। বইটিতে মোট ৪৫টি রচনার মাধ্যমে তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে নিজের ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত, আত্মবিশ্বাসের অভাব ও সংশয়ের মধ্যেও নতুন দিশা খুঁজে পেয়েছেন।

নতুন নাম, নতুন পরিচয়

লেখিকা তাঁর কলমের নাম রেখেছেন ‘ইফুংগিয়ং’, যার মানে ‘অভিন্ন দৃশ্যপট’। তাঁর মতে, এটি কেবল একটি নাম নয়, বরং সেই বিশ্বাস—যেখানে প্রতিটি সাধারণ দৃশ্যও নতুন ব্যাখ্যা পেতে পারে।

তিনি বলেন, জীবনে তাঁর সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল মায়ের অসুস্থতার সময় পাশে থাকা, পুলিশ অফিসার হওয়া, নিজের নাম পরিবর্তন করা, গিটার শেখা এবং সর্বশেষে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। বই প্রকাশের পরই তিনি অনুভব করেন যে তাঁর লেখকসত্তা এখন স্থির হয়েছে।

শব্দ ও সুরের মিলনে আত্মার গল্প

‘বইয়ের পাতায় মিশে থাকা ক্লাসিক’ এবং ‘গোলাপি দিকনির্দেশনা রেখা’—এই দুই গ্রন্থ দুটি ভিন্ন দিক থেকে হলেও আমাদের একই জায়গায় নিয়ে আসে: জীবনের গভীর অনুভূতির কাছে।

একদিকে, পার্ক সোহিয়নের বই পাঠককে শিল্প ও সংগীতের ইতিহাসের ভেতরে নিয়ে যায়, অন্যদিকে ইফুংগিয়ং-এর আত্মজৈবনিক রচনায় উঠে আসে একজন নারীর জীবন, সংগ্রাম ও আত্মপ্রকাশের গল্প। দুই লেখকই দেখিয়েছেন—শব্দ ও সুর কেবল প্রকাশের মাধ্যম নয়, আত্মার ভাষাও হতে পারে।

এই দুই বই এমন পাঠকদের জন্য এক অভাবনীয় অভিজ্ঞতা দেবে, যারা জীবন, সাহিত্য ও সংগীতের মিলনবিন্দুতে দাঁড়িয়ে এক নতুন দৃষ্টিতে চারপাশকে দেখতে চান।