বইয়ের ভুবন: শরতের আরামদায়ক পাঠ এবং বই নিষিদ্ধের বিতর্ক
শরতের স্নিগ্ধতায় বইয়ের উষ্ণতা
পাতা ঝরার শব্দ আর বাতাসে হালকা ঠাণ্ডার আমেজ—এই পরিবেশটাই যেন বই পড়ার জন্য আদর্শ। দীর্ঘ রাতের ক্লান্তি দূর করতে এক মগ গরম কফি বা চায়ের সাথে একটি ভালো বইয়ের কোনো তুলনা হয় না। ঠিক যেমনটা করে কুমড়োর মসলা দেওয়া পানীয় (pumpkin-spiced), তেমনি কিছু বই আছে যা হৃদয়ে উষ্ণতা ছড়ায় এবং সামনের দীর্ঘ শীতের রাতগুলোর জন্য মনে সাহস জোগায়। যখন প্রকৃতি রং বদলায় এবং তাপমাত্রা কমতে শুরু করে, তখন একটি আরামদায়ক কম্বলের নিচে বসে এই ধরনের বইয়ের জগতে ডুবে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। ঐতিহাসিক নাটক, ফ্যান্টাসি অ্যাডভেঞ্চার বা মন ভালো করা রোমান্টিক উপন্যাস—প্রতিটি বই যেন একটি উষ্ণ সাহিত্যিক আলিঙ্গনের মতো।
এই শরতের আরামদায়ক কিছু বই
এই মৌসুমে পড়ার জন্য বেশ কিছু বই সমাদৃত হচ্ছে। এর মধ্যে রিচার্ড ওসমানের “দ্য থার্সডে মার্ডার ক্লাব” অন্যতম, যা চারজন প্রবীণ ব্রিটিশ নাগরিকের অপরাধ সমাধানের গল্প। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সের জন্য নির্মিত চলচ্চিত্র থাকলেও, বইটি আরও বেশি আনন্দদায়ক। এর ব্যঙ্গাত্মক রসবোধ পাঠককে হাসাতে বাধ্য করবে।
যারা প্যারানরমাল রোম্যান্স পছন্দ করেন, তাদের জন্য রয়েছে এরিন স্টার্লিং-এর “দ্য এক্স হেক্স”। এটি জাদু এবং আবেগের মিশ্রণে একটি হালকা মেজাজের গল্প। এটি দুই জাদুকরের অভিশাপ কাটানোর চেষ্টা এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে লেখা।
ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা সারাহ উইনম্যানের “স্টিল লাইফ” একটি অনবদ্য সৃষ্টি। ১৯৪৪ সালের ইতালির প্রেক্ষাপটে, একজন তরুণ ব্রিটিশ সৈনিক এবং একজন প্রবীণ শিল্প ইতিহাসবিদের সাক্ষাৎ ও তাদের পরবর্তী জীবন নিয়ে এই দশকের পর দশক বিস্তৃত উষ্ণ গল্প বোনা হয়েছে।
অন্যদিকে, সারাহ বেথ ডার্স্টের “দ্য স্পেলশপ” তাদের জন্য, যারা “কটেজকোর ফ্যান্টাসি রোম্যান্স” পছন্দ করেন। এক জাদুকরী সাম্রাজ্যের লাইব্রেরিয়ান কিয়েলার গল্প, যে রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে পালিয়ে শৈশবের শহরে ফিরে আসে।
সাইমন ভ্যান বুয়ের “সিপসওয়ার্থ” একটি হৃদয়গ্রাহী উপন্যাস। এটি হেলেন কার্টরাইট নামের এক প্রবীণ নারীর গল্প, যিনি স্বামী-সন্তান হারিয়ে ইংল্যান্ডের গ্রামে ফিরে আসেন। একাকীত্বে ডুবে থাকা হেলেনের জীবনে একটি ছোট ইঁদুরের আগমন তার মধ্যে বেঁচে থাকার আগ্রহ নতুন করে ফিরিয়ে আনে।
সবশেষে, টিজে ক্লুনের “দ্য হাউস ইন দ্য সেরুলিয়ান সি” একটি আধুনিক ফ্যান্টাসি, যা এক বাতিকগ্রস্ত জাদুকরী এতিমখানা এবং বনপরীদের নিয়ে এক অদ্ভুত সুন্দর গল্প। তবে এর মূল বিষয়বস্তু কেবল জাদু নয়, বরং জীবনের কঠিন এবং কোমল দিকগুলো।
বইয়ের ভিন্ন দিক: আরাম বনাম বিতর্ক
উপরের বইগুলো যেখানে পাঠককে মানসিক শান্তি বা আরাম দেয়, সেখানে এমন কিছু বইও রয়েছে যা পাঠককে গভীরভাবে ভাবতে শেখায় বা সমাজের প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। কিন্তু যখন এই চ্যালেঞ্জগুলো বিতর্কের জন্ম দেয়, তখন কী ঘটে? সম্প্রতি লেখক মার্ক হিনসন তার এক লেখায় বই নিষিদ্ধকরণের এই বিষয়টিই তুলে ধরেছেন, যা ভিন্ন এক দৃষ্টিকোণ উন্মোচন করে।
বই নিষিদ্ধের সংস্কৃতি ও কিছু উদাহরণ
হিনসন তার স্কুল জীবনের স্মৃতিচারণ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়া মরিস সেন্ডাকের “হোয়ার দ্য ওয়াইল্ড থিংস আর” বইটিই ছিল লাইব্রেরি থেকে নেওয়া তার প্রথম বই। এটি ম্যাক্স নামের এক বাচ্চার কাল্পনিক দ্বীপে দৈত্যদের সাথে মিলিত হওয়ার গল্প। হিনসন জানান, এই বইটিই তার পড়ার আগ্রহ তৈরি করে। অথচ এই বইটি বিভিন্ন সময়ে এর “অন্ধকার মেজাজ” এবং অতিপ্রাকৃত বিষয়ের জন্য সমালোচিত হয়েছে এবং নিষিদ্ধের আহ্বানের মুখে পড়েছে।
চতুর্থ শ্রেণীতে হিনসন মার্ক টোয়েনের ভক্ত হয়ে ওঠেন, বিশেষ করে তার “দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অফ হাকলবেরি ফিন” উপন্যাসটির। এই উপন্যাসটি, যেখানে এক শ্বেতাঙ্গ কিশোর ও এক পলাতক কৃষ্ণাঙ্গ দাসের মিসিসিপি নদী বেয়ে ভ্রমণের গল্প বলা হয়েছে, তা লেখকের কাছে বাস্তবসম্মত মনে হয়েছিল। কিন্তু প্রকাশের সময়েই (১৮৮৫) আমেরিকার উচ্চবিত্ত সমাজ বইটিকে “অমার্জিত” ভাষা ব্যবহারের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল। হিনসন উল্লেখ করেন, আজও বর্ণবাদী শব্দ (এন-ওয়ার্ড) ব্যবহারের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উপেক্ষা করে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়, যদিও চরিত্রগুলো তাদের সময় অনুযায়ী কথা বলেছে।
ষষ্ঠ শ্রেণীতে হিনসন জোসেফ হেলারের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন স্যাটায়ার “ক্যাচ-২২” পড়েন। কিছু রসবোধ তার বয়সের জন্য কঠিন হলেও তিনি নতুন অনেক শব্দ শিখেছিলেন। এই বইটিও বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। হিনসন তার লেখার মাধ্যমে এই প্রশ্নটিই তুলে ধরেছেন যে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বা সাহিত্যিক মূল্য বিচার না করে কেবল বিতর্কিত বিষয়ের জন্য বই নিষিদ্ধ করা কতটা যৌক্তিক।